গুপ্তমনির সাত কাহন

 অরণ্য,ঝাড়গ্রাম-৮ই অক্টোবর:

৬নং জাতীয় সড়কের উপর খেমাশুলি ও লোধাশুলির মাঝে অবস্থিত মা গুপ্তমনি মন্দির। রাস্তা দিয়ে যে গাড়িই যাচ্ছে মন্দিরের উদ্দেশ্যে টাকা ছুঁড়ে দিয়ে যাচ্ছে। প্রচলিত এখানে মা কে ভক্তি ভরে প্রনাম করে দক্ষিণা দিয়ে গেলে যাত্রা শুভ হয়। দক্ষিণা দেওয়ার প্রচলন নাকি মা নিজেই করেছেন। তাঁর পুজোর খরচ তিনিই নিজে ব্যবস্থা করেছিলেন। আজ থেকে প্রায় ৭৫০ বছর আগের কথা। ঝাড়গ্রামের  তৎকালীন রাজা নিজের রাজ্যকে রক্ষার জন্য রাজপ্রাসাদ থেকে বেশ কিছু গুপ্ত রাস্তা বানিয়ে ছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল সুকনি বাসার গুপ্ত রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে একদিন রাজার প্রিয় হাতি জঙ্গলে হারিয়ে যায়। রাজা খবর পেয়ে তৎক্ষণা সৈন্যবাহিনী নিয়ে তার প্রিয় হাতির খোঁজ শুরু করেন। বর্তমান মন্দিরের কাছে গিয়ে দেখেন সেখানে গভীর অরণ্যের মাঝে লতা পাতা দিয়ে বাঁধা আছে। রাজা হাতিকে আনার জন্য শত চেষ্টা চালালে সফল হতে পারলেন না। যে হাতি রাজার কথা শুনতো সেই হাতি রাজা কে চিনতে পারছে না। রাজা শেষমেষ রাজপ্রাসাদ ফিরে আসেন সেই রাত্রে রাজা স্বপ্নাদেশ পান। এক দেবী তাকে জানালেন তোমার যে গুপ্ত রাস্তা রয়েছে তার পাশেই আমি রয়েছি এখানে একজন আমাকে দীর্ঘদিন ধরে সেবা করে আসছেন সুকনি বাসার বাসিন্দা শবর পরিবারের নন্দ ভক্তা তার নাম, তার সাথে তুমি গিয়ে যোগাযোগ করো। সেখানে আমাকে প্রতিষ্ঠা করো। 

তোমার হাতি তুমি ফিরে পাবে। সেই কথামতো তার পরের দিনই রাজা সুকনিবাসা গিয়ে পৌঁছায় এবং নন্দ ভক্তাকে সব কথা খুলে বলেন রাজা বাহাদুর, তারপরে নন্দ ভক্তা জঙ্গলে এসে তুলসী বেলপাতা জল দিয়ে মায়ের পুজো করেন এবং রাজা রূপনারায়ণ মাল্লদেব কে বলেন রাজা বাহাদুর এখন আপনার হাতি কে আপনি ডাকুন আপনার কথা শুনবে। তারপর রাজা তার প্রিয় হাতিকে রাজপ্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। এর পরই বর্তমান স্থানে রাজা মন্দির গড়ে দেন। তখন থেকেই এখানে মায়ের পুজো শুরু হয়েছিল, মা যেহেতু এখানে গুপ্ত জায়গায় রয়েছিলেন তাই মায়ের নাম গুপ্তমনি হিসেবে পরিচিত হয়। মন্দির হলেও নিত্য পুজার খরচ কিভাবে হবে? তখন মা নিজেই তার সমাধান করেন। মন্দির সামনে দিয়ে কেউ যেতে গেলে মাকে পুজো না দিয়ে যেতে পারতো না । সেই থেকে পয়সা দিয়ে যাওয়ার প্রচলন। এখানে কোন পুরোহিত দিয়ে পুজো হয় না। গীতা পাঠ, চণ্ডীপাঠ, কিছুই হয় না। তৎকালীন শবর পরিবারের নন্দ ভক্তা যেভাবে পুজো করতেন ঠিক একই রকমভাবে এখনো সবররাই পুজো করে আসছেন। দুর্গাপূজোর সময় এখানে ঘট বসিয়ে পূজা হয় এবং যে মূর্তি এখানে আবির্ভাব হয়েছিল সেই মূর্তিকে পুজো করেন শবররা। কথিত আছে এই মন্দিরে আজও সন্ধ্যায় নিমজ্জিত হয় অন্ধকারে, মন্দিরের ভিতরে কোনদিন আলো জ্বালানো হয় না। এখানে বলি প্রথা রয়েছে প্রতি সপ্তাহে বুধবার শনিবার বলি হয়। কারো কোন কিছু হারিয়ে গেলে হাতি ঘোড়ার মাটির মূর্তিতে সুতো বেঁধে দিয়ে এখানে মানসিক করলে তা পরে ফিরে পাওয়া যায়। এই সমস্ত অঞ্চলে কেউ গাড়ি কিনলে মা গুপ্তমনির কাছে প্রথম পুজো দেন। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে পূজো দিতে আসে। কলকাতা মুম্বাইগামী ছয় নম্বর জাতীয় সড়কের পাশেই অবস্থিত মা গুপ্তমনি মন্দির ঝাড়গ্রাম থেকে মাত্র ২৭ কিলোমিটার দূরত্ব এবং খড়গপুর থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরত্ব মায়ের এই মন্দির।

Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.